আপডেট : ১৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০
ফটো ফিচার
সেলফি ভয়ঙ্কর
তানভীর আহমেদ
স্মার্টফোনে নিজের ছবি তোলাকেই সেলফি বলে। এখন বোধজ্ঞান হারিয়ে অনেকে সেলফি তুলছেন। মনোচিকিৎসকরা এই সেলফি আসক্তদের বলছেন মানসিকভাবে অসুস্থ। সেলফি আসক্তরা সেলফি তুলছেন লাশের সঙ্গে, কবরে নেমে, দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত মানুষের সঙ্গে। সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণবাজি রেখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন বাস, ট্রেনের ছাদে, বাড়ির ছাদের কার্নিশে, পাহাড় চূড়ায়, ভয়ঙ্কর খাদের কিনারায়। কেউ সিংহ, বাঘ, কুমিরের মুখের ভিতর ঢুকিয়েছেন মাথা, গায়ে আগুন লাগিয়েছেন, হাত-পা কেটে রক্তাক্ত অবস্থায়ও তুলছেন সেলফি। বিপজ্জনক এই সেলফি আসক্তিতে বিশ্বজুড়ে ঘটছে দুর্ঘটনা, মরছে মানুষ...
ভয়ানক মানসিক ব্যাধি
সেলফি তুলতে যারা সারাক্ষণ নিজের চেহারা-পোশাক নিয়ে ব্যস্ত, যারা রেস্টুরেন্টে খাওয়া বাদ দিয়ে, শপিংমলে শপিং বাদ দিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে থেকেও আড্ডা বাদ দিয়ে, ঘরোয়া উৎসব, সামাজিক উৎসবে শামিল না হয়ে শুধু সেলফি তোলাতেই মগ্ন তারা মানসিকভাবে অসুস্থ বলেই মানছেন চিকিৎসকরা। মার্কিন গবেষকরা দাবি করেছেন, নিজের চেহারার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আমেরিকান সাইক্রিয়াটিক অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, অতিরিক্ত নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেওয়ার এই মানসিক সমস্যার নাম ‘সেলফিটিস’। গবেষকরা এই মানসিক সমস্যার সমাধানে সাময়িক চিকিৎসা হিসেবে কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি (সিবিটি) কাজে লাগতে পরামর্শ দিয়েছেন। মানসিক রোগের চিকিৎসকেরা দাবি করছেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার সঙ্গে নার্সিসিজম ও আসক্তিরও সম্পর্ক থাকতে পারে। সেলফি আসক্তরা ধীরে ধীরে এই আসক্তিতে মগ্ন হয়ে পারিবারিকভাবে ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন— একাকিত্ব, বিষণ্নতায় ভুগে নিজে থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সেলফিতেই মৃত্যু
২০১৪ সালে সেলফি তুলতে গিয়ে ৩৩ হাজার মানুষ মারাত্মকভাবে দুর্ঘটনায় আহত হন। এরা গাড়ি চালানোর সময়, পথে চলতে গিয়ে, কথা বলতে বলতে তোলেন সেলফি। ব্যস্ত রাস্তায় সেলফি তোলা, সেলফি ছবি দেখা ও এডিট করা, ফেসবুক, টুইটারে আপলোড করার সময় দুর্ঘটনায় পড়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাবে ২০১৫ সালে সেলফি তোলা সংক্রান্ত দুর্ঘটনায় ভারতে ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সে বছর সবমিলিয়ে ২৭ জনের ভয়ঙ্কর মৃত্যুর পেছনে দায়ী এই সেলফি তোলার রোগ। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা জানায় ভারত ও
এ অঞ্চলে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। হিন্দুস্তান টাইম জানায়, ২০১৪ সালে ১৯ জন মানুষ খুন হয়েছেন সেলফি তোলার অসতর্ক মূহুর্তে। অন্য হিসাব বলছে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত সেলফি তোলা সংক্রান্ত ভারতে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেলফি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পাহাড় বা উঁচু স্থান থেকে পড়ে মারাত্মক আহত হয়ে মরেছেন অনেকে। সমুদ্র, খাল বা জলাধারে ডুবেছেন সেলফি তুলতে গিয়ে। সেলফিতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে গাড়ি দুর্ঘটনায়, ভয়ঙ্কর পশুর কবলে পড়ে। সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর হিসাবটা বেড়ে চলেছে দিন দিন। এ অবস্থা আরও আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে।
>> ফেসবুকে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে এই সেলফিটি। কিছু অনলাইন মিডিয়াও এটি নিয়ে খবর প্রকাশ করে। আপনজনের কবর খোঁড়ার সেলফিতে হাসিমুখে কয়েকজন তরুণ সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয়। এছাড়াও কেউ কেউ লাশের দাফন-কাফন, কবরস্থ করা সব কিছুরই সেলফি প্রকাশ করেন বিচিত্র উন্মাদনায়!
>> স্পেনের বার্সেলোনায় অগ্নিকাণ্ডের সামনে সেলফি তোলায় শাস্তি পেতে হয় সেলফি আসক্তদের। এখন সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্প, বোমা হামলা, সন্ত্রাসী হামলা ছাড়াও বড় দুর্যোগের পর সেলফি আসক্তরা আহতদের সাহায্য করা বাদ দিয়ে সেলফি তোলেন। দুর্ঘটনা যেন সেলফি তোলার উৎসবে পরিণত হয় তাদের কাছে
>> ফার্ডিন্যান্ড কুয়ালালামপুর থেকে বিমানে চড়েন। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ভেঙে পড়ে সমুদ্রে। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ফার্ডিন্যান্ড সে অবস্থাতেই তোলেন সেলফি! নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেও সেলফি তোলা চাই। বিভিন্ন দুর্ঘটনাতে মারাত্মক আহতদেরও এ ধরনের সেলফি তুলতে দেখা যায়।
>> হাসপাতাল কি বাসা— অসুস্থ, মৃতপ্রায় বিপদগ্রস্তের পাশে এ ধরনের অমানবিক সেলফি নতুন নয়। সেলফিতে তাদের হাসিমুখ দেখে ক্ষোভ জন্মায় সাধারণ মানুষের। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা খাদিজা বেগমকে পেছনে রেখে সেলফি তোলেন যুব মহিলা লীগের তিন নেত্রী। যুগ্ম সম্পাদক কোহেলি কুদ্দুস, যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল ও সংসদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবিনা আক্তার তুহিন। পরে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করেন কোহেলি কুদ্দুস।
>> মৃত মানুষের পাশে হাসিমুখে সেলফি তুলতে দেখা যায় অনেককে। নিকটাত্মীয়, স্বজন ছাড়াও দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেই ক্ষান্ত হন না সেলফি আসক্তরা, সেটা প্রকাশ করেন ফেসবুকে। লাশের পাশে হাসিমুখে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করতেও দেখা যায় তাদের। এছাড়া অনেকে পশু জবাই, পশুর চামড়া ছাড়ানো, পশুর কাটা মাথার রক্তাক্ত, বীভৎস সেলফিও তোলেন!
>> সচেতনতা বৃদ্ধিতে ফেসবুক, টুইটারে ভাইরাল হয় ভারতে তোলা এই সেলফি। পাহাড় চূড়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই পা দুলিয়ে, শরীর এলিয়ে শুয়ে আছে কিশোর-যুবক-যুবতীরা। তারুণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দুরন্তপনা পাগলামিতে রূপ নিয়েছে। উঁচু পানির ট্যাংকির প্রান্তে, ঝুলন্ত সেতুতে, পাহাড়ে, ঝরনায়, চলন্ত মোটরসাইকেলে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে দেখা যায় অনেককে। তারুণ্যের খেয়ালিপনায় সেলফিতে মৃত্যু যেন কাছেই!
>> দ্রুতগতির চলন্ত মোটরসাইকেলে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। গাড়ি, সাইকেল, বাস-ট্রাক চালানোর সময়, হেলিকপ্টার, ছোট বিমানে বসে সেলফি তুলতে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়ছেন সেলফি আসক্তরা। অনেকে সেলফি তোলেন রেললাইনে, আগুনের পাশে, ব্রিজ থেকে ঝুলে— এগুলো সবই মৃত্যু ডেকে আনতে পারে যে কোনো সময়।
>> আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও টুইটারে ভাইরাল হয় কুমিরের মুখে মাথা দেওয়ার এই সেলফি। শুধু কুমির কেন, ভয়ঙ্কর হাঙর, চিতাবাঘ, সিংহ, ভালুুক, সাপের সঙ্গে এ ধরনের উদ্ভট ও প্রাণঘাতী সেলফি তোলেন সেলফি আসক্তরা। এ যেন মানসিক বিকারগ্রস্ততার চূড়ান্ত। জীবন বাজি রেখে সেলফি তোলার এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা দিন দিন আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে— দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে।
>> মস্কোর আকাশছোঁয়া দালানের চূড়ায় সেলফি তুলেছেন কিরিল ওরেসকিন। বাড়ির ছাদে, পাহাড় চূড়ায়, ব্রিজের রেলিংয়ে, ট্রেনের ছাদে বসে নিরাপত্তা ছাড়াই এ ধরনের সেলফি-পাগলামি মৃত্যু ডেকে আনতে পারে যে কোনো সময়।
>> ইনস্টাগ্রামে এই ভয়ঙ্কর সেলফিটি প্রকাশ পায়। গায়ে আগুন লাগিয়ে সেলফি তোলেন এক যুবক। শুধু আগুন কেন, নিজের রক্তাক্ত হাত-মুখের ছবিও স্যোসাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন সেলফি ম্যানিয়াকরা।
>> সমুদ্র এমনিতেই ভয়ঙ্কর জায়গা। প্রকান্ড ঢেউ আর মাছের আক্রমণও কম-বেশি হয়েই থাকে। সেলফির যুগে তাও বাদ পড়ছে না। বেড়াতে গিয়ে সুইমিং-এ সেলফি আসক্তরা সরব। সেলফি তুলতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যু বরণ করছেন।
>> ম্যাট ফেন্ডলারের বিমানে আগুন ধরে গেলে লাফিয়ে পড়ে মারাত্মক আহত হন। প্রাণশঙ্কা থাকলেও চিকিৎসা নেওয়া বাদ দিয়ে আগে তোলেন সেলফি। আজকাল ভয়ানক আহত, জখম, অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে শুয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে বেড়ান।
0 comments:
Post a Comment